আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও গৃহ হস্তান্তর কাজের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সারা দেশের ন্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার ৪ হাজার ৭৭৯ টি পরিবারকে জমি ও গৃহ হস্তান্তর করা হয়।
হস্তান্তর কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি কথা বলেন উপকারভোগীরা।
এসময় বরিশালের বানারীপাড়া পৌরসভার উত্তর পার আশ্রায়ন প্রকল্পের উপকারভোগী মনোয়ারা সুন্দরী(মনোয়ারা বেগম) বলেন, ৭১ এ মিলিটারিরা আমাগো ঘর পোড়াইয়া দিছে, আমরা মা কোন ধ-কূল পায় নায়। ভিক্ষা কইরা একটা ঘর উঠাইছিলো হেডাও বইন্যায় চইল্যা গেছে। মায় আমাগো দুই বুইন লইয়্যা বানারীপাড়া প্রোপারে চইল্যা আইলো, তহন এইজায়গায় ওইজায় টাক খাই।
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, এরপর ১৮ বছর আগে মা আপনার বাড়ি গ্যাছিলাম আমিরুন্নেছারে লইয়্যা। এরপর আপনার সাথে আমি নামাজ পড়ছি, খানা খাইছি। আমনে নামাজের ঘরে বইস্যা মিলাদ-দুরুদ পরছেন। আর এহন আমারে আপনে ঘর দেছেন। আপনার বাড়ি থেকে আইয়া যে বাড়ি রইতাম হ্যাহান থেকে নামাইয়া দেছে। আমি রাইতে জোর দহলে পৌরসভার সামনে একটা পুরান হাসপাতাল, সেই ঘরে আমি আমার মাইয়া পোলা, মায়রে লইয়্যা আশ্রয় নিছি রাত্রে। সেই জায়গায় বইয়া আমার মা-ছেলে মারা গেছে। ১০ বছর থাহার পর সেখান থেকেও উচ্ছেদ করে দিলে আমি কোন ধ-কূল পাই নাই। আইজ যেহানে বইয়া কথা বলতাছি, এহানে ৫ বার ঘর উঠাইছি, আর ৫ বারই উচ্ছেদ করছে, আমারে এককালে হুতাহারা (নিঃস্ব)করছে। তয় এহন যে ঘর দেছেন হ্যাহনে আমার ঘরে ১৫ জন লোক।
মনেয়ারা সুন্দরী প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমার চোঁখ একটা অন্ধ মাগো, এই যে বানারীপাড়া, উজিরপুর, বরিশালের নেতা-কর্মীরা যারা আছেন সবাই আমারে ভালো যানে। এই ঘর পাইয়া আমি খুশি, আপনার সাথে ভাত খাইছি, এহন একটু আসা আপনের সাথে আবার ভাত খামু। আপনি যদি একটু বানারীপাড়া আইতেন তয়, মা বানারীপাড়া ধন্য হইতে। আমনে যদি একটু বানারীপাড়া আইতেন, মা আসবেন। কত গরীব-দুঃখী মানুষ মা আপনার জন্য কানতাছে। আমনেরও মা-বাপ নাই, মোরও মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, বুইন নাই। মুই জনম দুঃখিনী, একটা দাবি করি আমনে একটু বানারীপাড়া আসেন মা, আমনের সাথে দুগ্গা খানা খাওনের আশা, আর কোন আশা নেই। আপনে ঘর দেছেন, ঠ্যাহি যেন স্বপ্ন দেখতাছি, কিন্তু এহন দেহি বাস্তবে, কি করমু আমনারে দিশা করতে পারিনা। মা আপনি একটু বানারীপাড়া আসেন দয়া কইরা ।
প্রতি উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আসবো আসবো, দেখি সময় পেলে আসবো।
পরে ওই নারীর প্রধানমন্ত্রীর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করে বলেন, মা আপনি হাজার বছর প্রধানমন্ত্রী থাকেন, আমি এইয়া দেখতে চাই। আবার যেন আপনারে জয়যুক্ত কইর্যা এই বানারীপাড়াইদ্যা আপনার গলায় মালা পড়াইতে যাইতে পারি।
এরপর একই আশ্রায়ন প্রকল্পের মোঃ হুমায়ুন নামে অপর উপকারভোগীর কথা শোনেন প্রধানমন্ত্রী। হুমায়ুন বলেন, দিন মজুর বাবার সন্তান আমি, আমার জন্মের আগেই ঘর-বাড়ি নদীতে ভেঙ্গে যায়, বাবা রাস্তার পাশে খুপরি ঘর তুলে বসবাস করতেন। বর্ষায় পানিতে তলিয়ে থাকতো আমাগো ঘর।
তিনি বলেন, অনেক কষ্ট করে বাবা পৃথিবী থেকে চলে গেলেও আমাদের জন্য স্থায়ী ঠিকানা করে যেতে পারেননি। আমার ঘরে স্ত্রী, মা ও কন্যা সন্তান রয়েছে, আমিও কোনদিন পারতাম না এরকম সপ্নের ঘর তৈরি করে দিতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি জীবনে সপ্ন দেখতাম না বিল্ডিং করে বসবাস করবো, কারন এজন্য যে পরিস্থিতি থাকা দরকার তা আমার নেই। কারন আমি দিনমজুরি করে দিন আনি দিন খাই। আপনি মমতামীয় মা বলেই আমাদের একটি দুইশতক জমির ওপর ঘর দিয়েছেন, পাশে পুকুরে, গভীর নলকূপ দিয়ে বিশুদ্ধ পানি পান করার সুবিধা, বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন। এ ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবো না। আপনার এই ঘর আমার কাছে রাজপ্রসাদের সমান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বরিশালের জেলা প্রশাসনক মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, বরিশাল জেলার ৫ হাজার ৯৩৫ টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মধ্যে ৩ হাজার ২৪০ টি পরিবারকে দুই শতক জমি সহ গৃহ প্রদান করা হয়েছে। আজ আরও ১ হাজার ৫০১ টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে দুই শতক জমি সহ গৃহ প্রদান করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সেইসাথে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ, মুলাদী, বাকেরগঞ্জ ও উজিরপুরসহ চারটি উপজেলাকে গৃহ ও ভূমিহীন ঘোষনা করেছেন।
তিনি বলেন, ৬ একর ৩০ শতাংশ জমি অবৈধ দখলমুক্ত করে সন্ধ্যা নদীর তীরে বানারীপাড়া পৌরসভার উত্তর পার আশ্রায়নে ৮৭ পরিবারকে পুনঃর্বাসিত করা হয়েছে। আরও ১৫০ টি পরিবারকে পুনঃর্বাসিত করার কার্যক্রম চলমান। এখানকার প্রতি শতাংশ জমির বর্তমান বাজার মূল্য ৬ লাখ টাকা ফলে দুইশতক জমিসহ প্রতিটি ঘরের মূল্য ১৫ লাখ টাকা। এখানে ৮৭ টি উপকারভোগী পরিবারের প্রত্যেকেই আজ থেকে ১৫ লাখ টাকার সম্পদের মালিক।
তিনি বলেন, এখানে বসবাসকারী উপকারভোগীদের সুবিধার জন্য সুন্দর পুকুর খনন করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নামাজের জন্য মসজিদ নির্মাণ ও কবরস্থান নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।
বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আমিন উল আহসান জানান, আজ বরিশাল বিভাগে তৃতীয় পর্যায়ের অবশিষ্ট ও চতুর্থ পর্যায়ে মোট ৪ হাজার ৭৭৯ পরিবারকে ২ শতক করে জমিসহ গৃহ প্রদান করা হয়েছ। এরআগে তিনটি পর্যায়ে বরিশাল বিভাগে মোট ২০ হাজার ১টি গৃহ নির্মাণপূর্বক গৃহ ও ভূমিহীনদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে।