কক্সবাজারের টেকনাফে বাহারছড়ায় পাহাড়ি অঞ্চলে অপহৃত সাত জনকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছেন পুলিশ। গত ১৭ মার্চ শুক্রবার বিকেলে টেকনাফের বাহারছড়া জাহজপুরা দক্ষিন পাহাড়ি এলাকা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। তবে অপহৃত পরিবারের দাবি, সাড়ে তিন লক্ষ টাকা মুক্তিপন দিয়ে তাঁরা ছাড়া পায়।
১৬ মার্চ (বৃহস্পতিবার) দুপুরে টেকনাফের জাহজপুরা পাহাড়ি এলাকায় থেকে তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে যান অপহরণকারীরা। ৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর মোহাম্মদ আমির (১১) ও রিফাত উল্লাহ (১২) নামের ২ জনকে ছেড়ে দিলেও জিন্মি রাখা হয়েছিল ৭ জন। উদ্ধার হওয়া ৭ জন হলেন, উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন (১৭), ফজল করিম (৩৮), জাবেরুল ইসলাম (৩৫), আরিফ উল্লাহ (২২), মোহাম্মদ রশিদ (২৮), মোহাম্মদ জাফর (৩৮), মোহাম্মদ জয়নুল (৪৫), মোহাম্মদ আমির (১১) ও রিফাত উল্লাহ (১২)। ৭ জনের মধ্যে একজন কলেজ ছাত্র।
এ বিষয়ে অপহৃত ফেরত আসা জাফর আলমের ছেলে করিম উল্লাহ বলেন, ‘আমার বাবা উদ্ধার হয়েছে। চৌকিদার ইসহাকের মাধ্যমে মুক্তিপণের ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। বাবাকে মারধর করেছে। উদ্ধার হওয়ার পর বাবাকে পুলিশ সাথে নিয়ে যায়।’
অপহৃত ফেরত আসা ফজল করিমের স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামী উদ্ধার হয়েছে। স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার দিতে হয়।
তবে পুলিশের বিশেষ অভিযানে অপহৃতদের উদ্বার করা হয়েছে উল্লেখ করে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হালিম জানান, ‘দুর্গম পাহাড়ে জেলা গোয়েন্দা টিমসহ আমাদের সাঁড়াশি অভিযানে কলেজ ছাত্রসহ অপহৃত ৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে।’
উদ্ধাকৃতদের আমরা হেফাজতে নিয়ে, জিজ্ঞেসাবাদ করতেছি। এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে। তবে মুক্তিপনের বিষয়টি জানা নেই।
এ বিষয়টি স্বীকার করে টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ রফিক বলেন,’পুলিশের প্রচেষ্টায় সাতজনকে ২৪ ঘন্টার মধ্য পাহাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। মুক্তিপণ দেওয়ার বিষটি আমিও শুনেছি। তবে এটির কোন সত্যটা নেই। কিন্তু রমজানকে সামনে রেখে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
জানা যায়, ইউনিয়নের দমদমিয়া বিজিবি বিওপি সংলগ্ন পিছনের পাহাড়ে ১৫-২০ জনের সশস্ত্র একটি গ্রুপ অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে কিশোর সংখ্যা বেশি এবং সবাই রোহিঙ্গা। তারা গত ৩রা মার্চ ৪ জনকে অপহরণ করেছিল। তাদের ব্যাপক মারধর করে একেক জন থেকে ৪০ হাজার, ২০ হাজার, ১০ হাজার করে মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়।
শুধু তাই নই, এ ঘটনা কাউকে বললে ফের ধরে নিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। তাই ফিরে আসা অপহৃতরা ওই দুর্বৃত্তদের বিষয়ে ভয়ে মুখ খোলে না। মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা একজন জানান, তাদের ধরা মাত্রই চোখে কাপড় বেঁধে দেয়, হাত পিছমোড়া বেঁধে দুইজন দুইপাশ থেকে টেনে গভীর পাহাড়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে বেঁধে রেখে কয়েক দফা পিটানোর পর ৪-৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে এবং পরিবারের সদস্যদের মুঠোফোনে কল দিয়ে টাকা আদায় করে। টাকা দিতে যত দেরি করা হয়, ততই নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ সশস্ত্র গ্রুপটি সন্ধ্যা নামলেই দমদমিয়াস্থ আম বাগানে সারা রাত অবস্থান করে। ভোর হলেই পাহাড়ে চলে যায়। এ নিয়ে স্থানীয়রা আতঙ্গে রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সহজে কেউ মুখ খোলে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বয়স্ক ব্যক্তি জানান, এশা ও ফজর নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদে আসতেও ভয় লাগে। কখন ওই দুর্বৃত্তরা আক্রমণ বা অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারা সকলে রোহিঙ্গা। তিনি রোহিঙ্গাদের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
অপর এক যুবক বলেন, এই দুর্বৃত্তরা ওপেন সিক্রেট। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না। রাত হলেই তাদের ভয়ে ঘুম হারাম হয়ে যায়। সে আরও জানায়, ছদ্মবেশে দোকান থেকে নাস্তাসহ প্রয়োজনীয় মালামাল পাহাড়ের দিকে নিয়ে যেতে কয়েকবার দেখেছে। কিন্তু কিছু বলার ও করার সাহস হয় না।
শিগগিরই সশস্ত্র এই গ্রুপের বিরুদ্ধে পাহাড়ে তল্লাশি অভিযান জরুরি বলে মনে করেন সচেতন মহল। ওই ৯ জন ছাড়াও গত ৬ মাসে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক ৪১ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা হলেও ২৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা। যেখানে ২২ জন মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ফেরত আসার তথ্য জানিয়েছিল। সর্বশেষ গত ৩রা মার্চ ২ শিশু অপহরণের ৮ ঘণ্টা পর ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসে। এ ছাড়া ২১শে জানুয়ারি হোয়াইক্যং-শামলাপুর সড়ক পাহাড়ি ঢালের ভেতর থেকে মোহাম্মদ হোসেন নামে এক ইজিবাইক চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।